ডেঙ্গু জ্বরঃ আতংক নাকি মোকাবেলা করবেন?

বর্তমান সময়ের সব থেকে বড় আতংকের নাম ডেঙ্গু জ্বর এবং এর ফলে মৃত্যু। প্রথমে ঢাকায় এর প্রকোপ অত্যাধিক হলেও ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে । প্রতিদিন সারা দেশে কম করে হলে ৮০০ থেকে ১০০০ নতুন মানুশ ডেঙ্গু ভাইরাসের শিকার হচ্ছেন । ও হ্যাঁ বলা হয়নি, ডেঙ্গু মুলত একটি ভাইরাস জনিত জ্বর। কিন্তু এবার এর প্রকোপ এতোটাই বেশি যে মানুশ সামান্য জ্বরেই ছুটেছে ডেঙ্গুর উপস্থিতি পরিক্ষা করতে ।

যাইহোক আজকের আলোচনার বিশয় বস্তু ডেঙ্গু । আশাকরি আমরা এর আদ্যোপান্ত সম্পর্কে আজ বিস্তারিত জানবো । জানবো ডেঙ্গু হলে আতংকিত না হয়ে  কিভাবে এর মোকাবেলা করতে হয়।

ডেঙ্গু জ্বর

ডেঙ্গু জ্বর

ডেঙ্গু কী ? কিভাবে এদের উৎপত্তি ?

ডেঙ্গু মুলত একটি মশা বাহিত ভাইরাস জনিত রোগ। এডিস ইজিপ্টি ফিমেইল মশাই মুলত এই ভাইরাসের মুল বাহক।

এডিস মশার জন্ম এবং বসবাস কোথায় ?

এডিস মশা নোংরা পানিতে জন্ম গ্রহন করে না বরং স্বচ্ছ ৩/৪ দিনের পুরাতন পানিতে এরা বংশ বিস্তার করে থাকে । এরা মুলত আমাদের বাসা বাড়িতেই বসবাস করে। বাড়ির আঙ্গিনা থেকেও বেশি মশা বসবাস করে আমাদের বড় বড় বাসা গুলতে। সে কারনে হয়তো সিটি কর্পরেশনের ডেঙ্গু সংক্রামন পরবর্তি পদক্ষেপ গুলো কম ইতি বাচক ভুমিকা পালন করছে। মশা সাধারণত বাসার ফ্রিজের নিচে ড্রয়ারে জমে থেকে পানিতে, বারান্দায় রাখা ফুলের টবে জমে থাকা পানিতে , গ্যারেজে পড়ে থাকা পরিত্যাক্ত টায়ারের ভিতরে জমে থাকা পানিতে কিংবা বাথরুমের কোমডে জমে থাকা পানিতে এই মশা জন্মায় এবং বসবাস করে । তাই আগে নিজেকে সচেতন হতে হবে । নিজের বাসা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ভয়াবহতা থেকে মানুশ রক্ষা পাবে।

ডেঙ্গু ভাইরাস এবং ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ ?

ডেঙ্গু ভাইরাস ও কিন্তু চার ধরনের । আপনাকে এডিস মশা কামড়ালাই যে আপনি আতংকিত হয়ে পড়বেন , তা কিন্তু না । এর মোট ৪ ধরনের হয়ে থাকে যা ডেন-১ , ডেন-২ , ডেন-৩ এবং ডেন-৪। এর যেকোন একটি সংক্রমণে ডেঙ্গু হয়।

এই গেল ভাইরাস পর্ব এবার আসুন জ্বরের প্রকার ভেদ। ডেঙ্গু জ্বর কে ডাক্তার গন ৩ টি ভাগে ভাগ করেছেন যা, “এ” , “বি” , “সি” ক্যাটাগরি নামে পরিচিত। প্রথম ক্যাটাগরির রোগিরা নরমাল থাকে এদের শুধু জ্বর হয়। আমাদের দেশের বর্তমান অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী “এ” ক্যাটাগরির। এদের হাস্পাতালে ভর্তির হবার কোন প্রয়োজন নেই তবে নিয়মিত ডাক্তারের স্বরনাপন্ন হলেই সুস্থ্য হয়ে উঠবেন।

“বি” ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগিদের সবাই স্বাভাবিক থাকে , কিন্তু তাদের শরীরে কিছু কিছু লক্ষন প্রকাশ পায়। যেমন পেটে ব্যাথ্যা , বমি কিংবা খাওয়া তে অরুচি । ক্ষেত্র বিশেষ দেখা যায় দুইদিন জ্বরের পড়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাস্পাতালে ভর্তি হতে হবে।

“সি” ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সব থেকে ভয়াবহ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের কে আইসিইউ তে রাখা প্রয়োজন হতে পারে ।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন কী ?

এই জ্বরের তীব্রতা অন্যান্য জ্বরের তুলনায় একটু বেশি । সেই সাথে শরীরে প্রচন্ড ব্যাথ্যা অনুভুত হয়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্জন্ত হতে পারে । শরীর বিশেষ করে হাড় , কোমর, পিঠ সহ অস্থিসন্ধি ও মাংশপেশি তে তীব্র ব্যাথ্যা অনুভুত হয় । এছাড়া ম্যাথ্যা ব্যাঠ্যা ও চোখের পিছনে ব্যাথ্যা হয় ।

জ্বরের ৪ থেকে ৫ দিন পরে দিনের সময় সারা শরীরে লালচে দাগ দেখা যায় । যাকে বলা হয় স্কিন রঙ বা দাগ যা অনেকটা ঘামাচি কিংবা এলার্জির মত। এর সঙ্গে বমি কিংবা বমি বমি ভাব লেগে থাকতে পারে । রোগী প্রয়োজনের তুমনায় বেশি ক্লান্ত অনুভব করে এবং খাওয়ার রুচি করে যায় ।

যদি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয় যেমনঃ- চামড়ার নিচে , নাক ও মুখ দিয়ে , মাড়ি ও দাত থেকে , কফের সঙ্গে , রক্ত বমি , পায়খানা সঙ্গে তাজা কালো রক্ত , চোখের বাইরে কিংবা চোখের মধ্যে দিয়ে রক্ত পড়ে তাহলে অবস্থা জটিল এর দিকে ধাবিত হয় ।

এই রোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় বুকে পানি , পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে । অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস , কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে ।

ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয়

যদি উপরের উপসর্গ এর সাথে আপনার জ্বরের মিল পাওয়া যায় তবে সম বিলম্ব না করে খুব দ্রুত ডাক্তারের স্বরনাপন্ন হওয়া অতিব জরুরী । জারা এই সকল উপসর্গের সাথে মিল পেয়েও ডাক্তারের সাথে করেন নি , মুলত তারাই মারা গেছেন । উল্লেখ্য , ডেঙ্গু জ্বরের সাথে কখনো সর্দি – কাশি  প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া ইত্যাদি জড়িত থাকে না । যদি আপনার জ্বরের সাথে সর্দি কাশি কিংবা প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া থাকে তবে সেটা ডেঙ্গু জ্বর নয় , অন্য কোন রোগের লক্ষন ও হতে পারে । তাই জ্বর হলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা অতি উত্তম ।

ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে

ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত প্রচুর পরিমান পানি কিংবা পানি জাতিয় খাবার খেতে হয় যেমনঃ ডাবের শরবত , লেবুর শরবত , ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন গ্রহন করাতে হবে।

কোন ধরনের ঔষধ খাওয়া যাবে না

সাধারণত একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুশ এই জ্বর কালিন সময়ে দিনে সর্বোচ্চ ৪ টি প্যারাসিটামল গ্রহন করতে পারবেন , এর অধিক শরীরের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে । যদি কোন ব্যাক্তির লিভার , হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে তবে অবশ্যই সেবনের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ।

ডেঙ্গু জ্বরে মাথা ব্যাথ্যা হওয়ার কারনে অনেকেই অ্যাসপিরিন (ডিস্পিরিন) জাতিয় ঔষধ খেয়ে থাকেন যা বিপদ জনক । ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহনে রক্তক্ষরন হতে পারে ।

প্লাটিলেট বা রক্ত কনিকা কমে গেলে কি করনীয় ?

ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট বা রক্ত কনিকা কমে গেলে সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে ডাক্তারের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত । এতে প্রয়জনিয় ঔষধ ও চিকিতসার মাধ্যমে প্লাটিলেট এর মাত্রা পুর্বের ন্যায় আগের মত হয়ে যায় । সাধারণত একজন মানুশের রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট থাকে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্জন্ত ।

চিকুনগুনিয়ার মত কি ডেঙ্গু একবার হলে আর হয় না ?

সাধারণত চিকুনগুনিয়া একবার আক্রান্ত হলে আর  জিবনে আক্রান্ত হয় না । কিন্তু ডেঙ্গু এমন নয়। একজন মানুশ ৪ বার ডেঙ্গু তে  আক্রান্ত হতে পারে । প্রথমবার আক্রান্ত রোগী তেমন গুরুতর ভাবে আক্রান্ত না হলেও ধাপে ধাপে অর্থাৎ দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হলে রোগের তিব্রতা বাড়তে থাকে । এভাবে চতুর্থবারে আরো তীব্রতা বাড়ে ।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয়

ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে নিজেদের সচেতন হওয়া টে অনেক বেশি জরুরী। এডিস মশা যাতে বিস্তার লাভ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে যাতে কোথাও পানি না জমে থাকতে পারে , এছাড়াও সম্ভাব্য জমে থাকা পানি স্থান গুলো সময় সময় পর্যবেক্ষন করতে হবে এবং পানি জমে থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে ।

ডেঙ্গু হলে আতংকিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন , মনে রাখবেন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুধু প্যারাসিটামল সেবন করতে পারবেন প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে (যতক্ষন না ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন) । ডেঙ্গু জ্বর ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায় । অতংকিত না হয়ে মোকাবেলা করুন । জয় আপনার ই হবে।

Leave a Comment