কলকাতা শব্দটা মাথায় আনতেই ইদানীং অনুপম রায়ের কলকাতা গানের লাইন গুলো কানে ভাসে “শহর জুড়ে যেন প্রেমের মৌসুম………কলকাতা তুমিও হেটে দেখো ,কলকাতা তুমিও ভেবে দেখো……যাবে কিনা আমার সাথে…” ।
অসংখ্য প্রাসাদ, অট্টালিকা ও পুরনো স্থাপনার শহর কলকাতা। ইংরেজ শাসনামলের চিহ্ন এশিয়ার যে কয়টি হাতেগুনা শহরে টিকে আছে, কলকাতা তার মধ্যে শীর্ষে। শহরের দক্ষিণের অংশে ব্রিটিশরা বাস করতো যাকে বলা হতো হোয়াইট টাউন এবং উত্তর অংশে ভারতীয়েরা বাস করতো যাকে বলা হতো ব্ল্যাক টাউন। বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারনে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা কলকাতাকে ভারতের রাজধানী করে রেখেছিল কলকাতা নামের ইতিহাস বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ‘কলিকাতা’ নামটি এসেছে ফার্সিতে গৃহীত দুটি আরবি শব্দের সংযোগে – ‘কলি’ যার মানে অস্থির, এবং ‘কাতা’ যার মানে বদমাইসের দল বা খুনেরা। অনেক পরে ব্রিটিশ শাসকরা এর নাম দিয়েছিলো ক্যালকাটা – Calcutta। ভারত সরকার পুনরায় নাম বদলে করে কলকাতা।
স্যার রোনাল্ড রস, সি ভি রমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন এবং মাদার তেরেসা – কলকাতা শহর টোকিও ও কিয়োটোর পর এশিয়ার সবচেয়ে বেশী নোবেল বিজয়ী উপহার দিয়েছে।বাংলাদেশের মানুষকে কলকাতার বাঙ্গালীরা আলাদা কদর করে। বয়সীরা এখনো ডাকে ‘জয় বাংলার লোক’ বলে। তাদের বিস্ময় কাটেনি যে মাছে ভাতে বাঙালী যুদ্ধ করে নিজেদের জন্য একটা গোটা দেশকেই স্বাধীন করে ফেলেছে ।
কলকাতার রেলওয়ে সার্ভিস না দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না আসলে সার্ভিস কিভাবে করতে হয়।বোঁনগাও থেকে শিয়ালদহ যেতে লাগে প্রায় তিনঘন্টা। আমি শিয়ালদহর আগের স্টেশন উল্টডাঙ্গা বা বিধাননগর জংশনে নেমে গেলাম।বিধাননগরের পূর্ব নাম ছিলো সল্টলেক বাংলাই লবণহ্রদ। পরে এটাকে বিধাননগর করা হয়েছে।
ট্রেন থেকে নেমে আন্ডারপাস ধরে রোডে উঠলাম। তখন বিকাল বিকাল ভাব চলে এসেছে। ঘড়িতে ৩.৩০। সিটি সেন্টারে আসলেই চোখে পড়লো একটি লাইফসাইজ মডেল, একটি ঘোড়া চালিত ট্রাম। সারা কলকাতা জুড়ে এটি ঐতিহ্য বাহি গণপরিবহন। কলকাতা এসেছেন আর রাস্তাই ট্রাম দেখেন নি। এটা এক প্রকার অসম্ভব।

মুকুন্দপুর যাওয়ার বাসে উঠতেই বিকালের নরম আলো মুখে এসে পড়লো। একদম পিছনের দিকে একটি সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। জানলা দিয়ে ফুটপাতের দোকান গুলো দেখছি।
পরের দিন ধর্মতলা গেলাম।একদিক থেকে কলকাতার মূল পয়েন্ট এটিই। অনেক সকাল সকাল আসাই দোকানপাট তেমন খোলেনি এখনো। হালকা হালকা কুয়াশাচ্ছন চারিদিক, সকালের আলো কেবল ফুটছে। কলকাতাতে আসলে আরেকটা জিনিস দারুণ ভাবে চোখে পড়বে সেটা হলো কাক। এদিক ওদিক সেদিক সবখানে।প্রথমে গেলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালসসে। ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধি প্রাপ্ত রাণি ভিক্টোরিয়ার মূর্তিটি আগাগোড়া শ্বেত পাথরের তৈরি। এখানে একটা জাতীয় সংগ্রহশালাও আছে।

ধর্মতলাতে এসে সবার আগে যেটা চোখে পড়বে সেটা সেন্ট পল’স। এটি একটি আ্যালিংক্যান ক্যাথিড্রাল। মূলত এটি গথিক স্থাপত্য। এশিয়ার সর্ব প্রথম এপিস্কোপ্যাল চার্চ এটি। ১৯ শ শতকে ইউরোপীয়দের আনাগোনা বেড়ে যাওয়াই তাদের কথা মাথায় রেখেই এই নির্মাণ করা।
আরেকটু সামনে লেনিন রোড এর শুরুতেই দেখতে পাবেন মুঘল সম্রাজ্ঞী টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পূত্র প্রিন্স গোলাম মোহাম্মদের নির্মিত ঐতিহাসিক টিপু সুলতান মসজিদ
মসজিদের ওপর পাশে আছে বাঙালির পরচয় বহন করা ” কে সি দাসের মিষ্টির দোকান”। মূলত কে সি দাসের দাদা নবীনচন্দ্র ছিলেন এই মিষ্টির কারিগর। তাকে “বউবাজারের কলম্বাস ” বলে ডাকা হতো এক সময়। দাদার ক্যারিশমাকে “কে সি দাস” ব্রান্ড করেছিলেন কে সি দাস। ছানার রসগোল্লা সহ এখানে পাবেন ছানার পায়েস”, “অমৃত কলস”।যা বাঙালীর রসনাকে তৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট।

বউবাজার অঞ্চলদিয়ে হাটতে হাটতে চলে এলাম কলেজ স্ট্রিটে। বই প্রেমিক মানুষদের জন্য এম স্বর্গ রাজ্য। বউবাজার অঞ্চলের গণেশ চন্দ্র এভিনিউ মোড় থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড মোড় পর্যন্ত দেড় কিলো রাস্তাটাই মূলত কলেজ স্ট্রিট। সারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইয়ের বাজার এটি। বলা হয় যে বই কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যাবে না সে বইয়ের অস্তিত্বই নেই। ভালো করে খুঁজলে আমি কনো কনো বইয়ের মূল হাতে লেখা কপিও খুঁজে পেয়ে যেতে পারেন।
হাটতে হাটতে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে জমপেশ। তাই দেরি না করে বাজ ধরে সোজা চলে গেলাম পার্ক স্ট্রিট। এখানকার আরসালান বিরিয়ানি হাউজের আলাদা নাম ডাক শুনেছি। নিজে তাই স্বয়ং চলে এলাম নিজেকে বিরিয়ানি প্রেমিক প্রমাণের জন্য।
হোটেলের দ্বিতীয় তলাতে গিয়ে কোনার একটা টেবিলে বসলাম। মেনু কার্ড দেখে আমি বরাবরের মতো কনফিউজড হয়ে গেলাম। কি নাম! চিকন মাটন, হায়দ্রাবাদি, লখনৌ! এগুলো সব বিরিয়ানিরর নাম। ভাবা যায়। আর যারা নিরামিষ তাদের জন্য রিয়েছে ভেজিটেবল বিরিয়ানি।
শেষ মেশ অর্ডার দিলাম লখনৌ। ওয়েটার প্লেটে বিরিয়ানি আনার পর আমি স্তম্ভ হয়ে গেলাম। বিরিয়ানি না বিরিয়ানি ঢিবি? এত একজনের পক্ষে শেষ করা দুষ্কর। যা হোক খাওয়ার পর বুঝলাম কেন এর এত নাম ডাক।
কলকাতার পূর্বে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে নিউটাউন। বিশ্ব বাংলা সরণি ধরে রাজারহাট। বলা যায় এটি নতুন কলকাতা। সব আইটি কোম্পানি সহ মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি গুলো এদিকে গড়ে উঠেছে। যেতে যেতে চোখে পড়বে নারকেল বাগানে বিশ্ব বাংলা রেস্টুরেন্ট, বিশ্ব বাংলা অডিটোরিয়াম, রবীন্দ্র তীর্থ। আরেকটু সামনে এগোলে ইকো পার্ক আর ঠিক তার দুই নাম্বার গেটের বিপরীতে দিকে আছে মাদার ওয়াক্স মিউজিয়াম৷ এত দূর এসে কিছুই দেখা কপালে ছিলো না। কারণ সোমবার এই এলাকা জুড়ে ছুটি। সব বিনোদনের স্পট গুলো অফ থাকে।
.কলকাতা দাদা দের শহর। এখানে সবাই দাদা। এখানে না এলে বাঙালি আনার যে স্বাদ তার ষোলকলা পূর্ণ হবে না। এখানে দেখার মতো আরো আছে হাওড়া ব্রিজ, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সায়েন্সে সিটি, শান্তি নিকেতন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িঃরবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। তার শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যুকাল যেনো এখনো ধারন করে আছে এই বাড়িতে। রবীন্দ্রচর্চার জন্য পারফেক্ট স্থান বলা চলে।এন্ট্রি ফিঃ৩০ রুপি(রেগুলার)

সায়েন্স সিটি:বিজ্ঞান কে আপনার কাছে জনপ্রিয় ও বিনোদনমূলক করতে চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন।এন্ট্রি ফিঃ৬০ রুপি।
হাওড়া ব্রিজঃখুব ভোরের/পড়ন্ত বিকেলের হাওড়া ব্রিজ ও দেখে নিতে পারেন। এখানেই মিলবে হিন্দুধর্মাবলম্বী দের পবিত্র গঙ্গা নদী।
এছাড়াও ইকো পার্ক,বিখ্যাত নাখোদা মসজিদ কিংবা ইডেন গার্ডেন ও যেতে পারেন।
এক দিকে হাতে টানা রিকশা, ব্যাস্ত পথে ট্রাম গাড়ি, পলেস্তরা খসে পরা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে থাকা জীর্ন ঘুপচি দালান বাড়ি, দুই একটি ঘোড়ার গাড়ি, দুই পাশে বনেদিয়ানার স্বাক্ষর বহন করা পুরনো অভিজাত দালান আর তার মাঝখানে সরু গলির পুরোনো কলকাতা আর এক দিকে ঝা চকচকে আধুনিক বিল্ডিং সমৃদ্ধ সল্ট লেকের নিউ কলকাতা। আর এ দুই এর মাঝে মধ্যবিত্তের পরিশ্রান্ত মুখ, লোকাল বাসে আর মেট্রোয় ঝুলে ঝুলে নারি পুরুষের কর্মস্থলে যাওয়া আসা, কনফিডেন্সে দীপ্তমান রমনীদের পদচারনা, রাস্তায় হকারদের ডাকাডাকি আর এর মাঝে শান্তির পরশ বুলিয়ে যাওয়া গড়ের মাঠ আর গঙ্গা থেকে ভেসে আসা তাজা হাওয়া এই নিয়েই তো কলকাতা, আপনার আমার চেনা খুব আপন একটি শহর। গঙ্গার তীরের এই বহু প্রাচীন শহর টি আমাকে এক অদ্ভুত ঋণে বেধে রেখেছে।
পরিবেশ সুস্থ রাখতে যত্র তত্র ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।
কলকাতা ভ্রমণ কাহিনী,কলকাতা ভ্রমণ খরচ,কলকাতা ভ্রমণ গাইড ২০২০,কলকাতা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা,কলকাতা ভ্রমণ স্থান,কলকাতা ভ্রমণ রচনা,কলকাতা ভ্রমণ ২০২০,কলকাতা ভ্রমণ গাইড ২০২০,কলকাতা ভ্রমণ গাইড,কলকাতা ভ্রমণ গাইড pdf,কলকাতা ভ্রমণ টিপস,কলকাতা ভ্রমণ স্থান,কম খরচে কলকাতা ভ্রমন,কলকাতার দর্শনীয় স্থানসমূহ,কলকাতার দর্শনীয় স্থানের নাম,কলকাতা হোটেল ভাড়া 2020,কলকাতার দর্শনীয় স্থানের ছবি,কলকাতার কাছে ঘোরার জায়গা,কলকাতা নিউমার্কেট হোটেল,কলকাতা শপিং গাইড,কলকাতার খাবার দাবার,বাসে কলকাতা ভ্রমন,
birbangla.com,