নাফাখুম অঞ্চলটি বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার একটি মারমা অধ্যুসিতএলাকা। মারমা ভাষায় খুম শব্দের অর্থহচ্ছে ঝর্না বা জলপ্রপাত বাজলপতন। রেমাক্রি খালের পানি প্রবাহ পাথুরেপথে নামতে গিয়ে চমৎকার এই জলপ্রপাতের সৃটিকরেছে। এই খানে নাফানামের এক প্রকার মাছপাওয়া যায়, এরা স্রোতের বিপরীতেলাফ দিয়ে ঝর্না পার হতে চেষ্টাকরে, আর এখানে স্থানীয়উপজাতীয়রা সহজেই সে মাছগুলোকে জালদিয়ে ধরে। সম্ভবত সেকারনেই এই ঝর্নার নামনাফাখুম।সবুজপাহাড়ী বন আর পাথুরেভুমির মাঝে নাফাখুম এইঅঞ্চলটি অসাধারন স্বপ্নময় সুন্দর স্থান। আমাদের দেশেই এত সুন্দর জায়গাআছে তা নিজের চোখেনা দেখলে বিশ্বাস হবে না।
নাফাখুম তো অনেকেই গিয়েছেন। কিন্তু এর নামকরণের স্বার্থকতা জানেন কয়জন?অত্যন্ত সুস্বাদু এই মাছের পাহাড়ি নাম নাফা। মারমা ভাষায় সঠিক উচ্চারণ ঙাফা। নাফা মাছ পাওয়া যায় বলেই রেমাক্রি খালের শেষ ঝর্ণা/খুমের নাম হয়েছে নাফাখুম।এখন শিকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে তাই পাহাড়ে বড় নাফা বিরল হয়ে পড়েছে। তবু মাঝে মাঝে দেড়-দুই মনের নাফা ধরা পড়ে যেগুলো খুমের ভেতরের গুহায় লুকিয়ে থাকে। খুব সাহসী শিকারীরা লম্বা দম নিয়ে ডুব দিয়ে গুহায় ঢুকে নাফাকে টেনে বের করে আনে। খুব বোকা ও অলস বলে সহজেই ধরা পড়ে যায় এই রিভার মনষ্টার। নাফা মাছ আকারে অনেক বড় সাইজের হয়ে থাকে।
নাফাখুম ভ্রমণ গাইড
নাফাখুম জলপ্রপাত বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত। পানি প্রবাহের পরিমানের দিক থেকে এটিকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলপ্রপাত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার কেউ কেউ একে বাংলার নায়াগ্রা বলে অভিহিত করেন। নাফাখুম দেখতে থানচি বাজার থেকে সাঙ্গু নদী পথে নৌকা দিয়ে রেমাক্রি যেতে হয়। রেমাক্রীতে রয়েছে মারমা বসতি, মারমা ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত।
রেমাক্রী থেকে প্রায় তিন ঘন্টা পায়ে হাটলে তবেই দেখা মিলে প্রকৃতির এই অনিন্দ্য রহস্যের। রেমাক্রী খালের পানি নাফাখুমে এসে বাক খেয়ে প্রায় ২৫-৩০ ফুট নিচের দিকে নেমে গিয়ে প্রকৃতি জন্ম দিয়েছে এই জলপ্রপাতের। দ্রুত গতিতে নেমে আসা পানির জলীয় বাষ্পে সূর্য্যের আলোয় প্রতিনিয়ত এখানে রংধনু খেলা করে। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হন ও বান্দরবানে ট্রেকিং করার ইচ্ছে থাকে, কিংবা দেখতে চান বান্দরবানের গহীনের সবুজের খেলা, উপজাতি জীবন চিত্র, সাঙ্গুর ভয়ংকর রূপ বা শীতের টলমলে পাথুরে জলের খেলা তবে আপনার জীবনে একবার হলেও যাওয়া উচিত অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণায়।আবার শীতকালে নাফাখুমে পানি অনেকটাই কম থাকে।
তাই সবচেয়ে আদর্শ সময় বর্ষার পর পর ও শীতকালের আগের সময়টুকু তবে যে সময়ই যান না কেন, এখানের প্রকৃতি আপনার ভালো লাগবেই। নাফাখুম ভ্রমণ আপনার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন।
বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়ার সময় পথে পরবে মিলনছড়ি, চিম্বুক ও নীলগিরি। চারপাশের অপুর্ব ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে দীর্ঘ পাহাড়ি পথের এই ভ্রমণ আপনার চোখ ও মনকে সতেজ করে রাখবে
থানচি পৌঁছে আপনাকে অবশ্যই একজন গাইড ঠিক করতে হবে। গাইড ছাড়া নাফাখুম ভ্রমণে যেতে পারবেন না। গাইড ঠিক করার পর আপনাকে থানচি বিজিবি ক্যাম্প/থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে। ভ্রমণকারী সকল সদস্যের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, কোথায় যাবে, কয়দিন থাকবে এইসব তথ্য কাগজে লিখে জমা দিতে হবে। আর এইসব কাজে আপনার গাইড সাহায্য করবে।
মনে রাখবেন বিকেল ৩ টার পর থানচি থেকে রেমাক্রি যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না। তাই সেইদিনই রেমাক্রি যেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ২টার মধ্যে থানচি থাকতে হবে। তা না হলে ঐদিন থানচি থেকে পরদিন সকালে রেমাক্রি যেতে হবে। এতে করে আপনার একদিন বেশি সময় লাগবে।অনুমতি পাওয়ার পর থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করতে হবে। এক নৌকায় ৫ জন যেতে পারবেন। যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। সাঙ্গুতে পানি কম থাকলে কিছু জায়গায় নৌকা থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে তখন সময় একটু বেশি লাগতে পারে। যাবার পথে সাঙ্গু নদীর রূপ আপনাকে বিমোহিত করে রাখবে। এছাড়া পথেই পরবে পদ্মমুখ, ভূ-স্বর্গ খ্যাত তিন্দু, রাজাপাথর বড়পাথর এলাকা ও রেমাক্রি ফলস।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে বান্দরবান যায় এমন প্রায় ১০/১২ টা পরিবহন আছে । সব থেকে ভালো সার্ভিস পাবেন শ্যামলী পরিবহন এবং হানিফ পরিবহন । এছাড়াও সেন্টমাটি’ন সাভি’স, ডলফিন, শান্তি, ইউনিক, এস আলম সহ আরো কিছু বাস সার্ভিস আছে । এসি সার্ভিসের মধ্যে আছে শ্যমলী আর সেন্টমাটি’ন পরিবহন, বাকী সব নন-এসি বাস । নন-এসি বাস ভাড়া জন প্রতি ৬২০/- আর এসি বাস ভাড়া জন প্রতি ৯৫০/- টাকা ।
ঢাকার ফকিরাপুল, ও কলাবাগান থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশে এসব বাস ছেড়ে যায় । সন্ধ্যার পর থেকে অথা’ৎ রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৩০ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে, এবং সকাল ৭:৩০ এর মধ্যে পৌছে যায় । বান্দরবান বাস স্ট্যান্ড থাকে থানচি বাজার বাস-স্ট্যান্ড যাবেন অটোতে করে জনপ্রতি ১০/- থেকে ২০/- টাকা নিবে । নাফাখুম ভ্রমনের পথ হবে বান্দরবান- থানচি – তিন্দু – রেমাক্রী – নাফাখুম ।
বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা সদরের দূরত্ব ৮১ কিঃমিঃ । সমুদ্র সমতল থেকে থানচি এর উচ্চতা ২ হাজার ২০০ ফুট । রিজার্ভ চাঁদের গাড়ীতে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে সময় লাগবে প্রায় পোনে চার ঘন্টা, পর্যটন মৌসুমে ভাড়া নেবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা । থানচি থেকে তিন্দু যেতে সময় লাগতে পারে আড়াই ঘন্টা । থানচি থেকে তিন্দু যাওয়ার পথে এখানে অনেক কাছ থেকে মেঘ দেখার সুযোগ মেলে ।
এলাকাটি প্রায়ই মেঘে ঢেকে থাকে । পূর্বদিকে তাকালে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলের সারি সারি পর্বতশৃঙ্গ । এই পথে যাওয়ার সময় চিম্বুক আর নীলগিরিতে নেমে কিছু ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলে নেমে কিছুটা বিশ্রাম ও ফটোসেশন করে নিতে পারেন । এই কারণে সময় হয়ত কিছুটা বেশী লেগে যেতে পারে । বাসে ও যেতে পারেন, ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৯০/-টাকা ।
এরপর থানচি থেকে নৌপথে আপনাকে পৌছতে হবে রেমাক্রী । এর আগে একজন গাইড নিয়ে নেওয়া ভাল । রেমাক্রী হতে নাফাখুম, নাফাখুম হতে রেমাক্রী প্রর্যন্ত আর কোন বাহন আপনি পাবেন না । ওই পথটা আপনাকে হেঁটে যেতে হবে অথবা নদীপথে ঠ্যালা নৌকায় । এই শীত মৌসুমে ঠ্যালা নৌকার ভাড়া নিতে পারে একদিনের জন্য ১,০০০/- টাকা । নাফাখুমে রওনা হওয়ার পূর্বে আবারও আপনাকে নাম ঠিকানা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্প হতে অনুমতি নিতে হবে । রেমাক্রী বাজার হতে নদীর কুল ঘেঁষে প্রায় দুই থেকে তিন ঘন্টায় পৌঁছবেন নাফাখুম ।
নাফাখুম ট্যুর প্ল্যান
কোথায় থাকবেনঃ
থানচিতে থাকার জন্য সরকারী রেষ্ট-হাউজ আছে । অনুমুতি নিয়ে সেখানে থাকতে পারেন । কিন্তু থানচিতে রাতে না থেকে আপনি সরাসরি রেমাক্রী চলে যেতে পারেন । রেমাক্রী বাজারটা খুবই ছোট । বাজারের মাঝখানে বিশাল একটা উঠান পেছনে থাকার ব্যবস্থা আর সামনে দোকান আছে । এখানে অল্প খরচে আপনি থেকে যেতে পারবেন ।
দরকারি পরামর্শ-
১। ভ্রমণের আগেরদিন থেকেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ঔষধ সেবন শুরু করুন।
২। বড় পলেথিন নিন, বিভিন্ন সময় আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস ভিজে যাওয়া থেকে মুক্তি পাবে এর মাধ্যমে।
৩। ব্যাগ হালকা রাখুন।
৪। কিছু সাধারণ ঔষধ, পেইন কিলার সাথে রাখুন। মশার জন্য ওডোমস নিতে পারেন।
৫। এই পথে জোঁকের সাথে সাক্ষাত হওয়াটাই স্বাভাবিক। পায়ে মোজা পড়ুন। সাথে লবণ, তেল ইত্যাদি রাখুন।
৬। নিজেকে সতেজ রাখতে গ্লুকোজ, স্যালাইন পান করুন। তবে অল্প অল্প করে।
৭। ভালো গ্রিপের জুতা পরবেন অবশ্যই।
৮। প্রকৃতির মাঝে যেয়ে অবশ্যই প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করুন, ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন।