দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে বড় দীঘি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া নদীর তীরে ‘সুন্দরী কমলা রানীর দীঘি’। ৫২৯ বছর আগের সেই দীঘি এখনও কালের সাক্ষী।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, চন্দ্রদ্বীপ রাজার শৌর্যবীর্যের স্মৃতি এই কমলা রানীর দীঘি। কমলা রানীর দীঘির পাড়ের উচ্চতা প্রায় ৪০-৫০ ফুট। এতবড়এবং উঁচু পাড় বিশিষ্ট দীঘি তখন এ বঙ্গে ছিলো প্রথম। ৫২৯ বছর আগের সেই খাল ও দীঘিটা এখন কালের স্বাক্ষী হয়ে নানা স্মৃতি বহন করছে।
কমলা রানী দীঘির ইতিহাস
দিঘী নিয়ে ইতিহাস: কথিত আছে ১৫৪০-৪৫ খ্রীষ্টাব্দে শেরশাহ শাসনামলে তার রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো গোটা রাজনগর এলাকা। পরবর্তীতে তার নামকরণে রাজনগর নামের উতপত্তি। ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে ভানু নারায়নের অবর্তমানে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুবিদ নারায়ন উত্তরাধিকার সূত্রে এ রাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। তার স্ত্রী অপরূপা ’কমলা’ রানীর ৫ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তান ছিলো। প্রজাবতসল, সমাজ সংস্ড়্গারক রাজা সুবিদ নারায়ন এক রাতে স্বপ্নে দেখেন, তার এলাকায় দীঘি খনন করতে হবে। স্বপ্নে দেখা অনুযায়ী দীঘি খননের প্রথম দিন মাটিতে কোদালের ছোঁয়া দানকারীকে রানী একটি স্বর্ণের হার উপহার দেন।
দীঘির অবস্থান ধরা হয় ১২ একর ১২ বিগা ১২ পোয়া ১২ ছটাক জায়গা। দীঘির কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার পর দীঘিতে পানি উঠছে না দেখে রাজা সুবিদ নারায়ন বিস্মিত হয়ে পড়েন।তখন লোকে বলে
এর কিছুদিন পরই রাজা পুনরায় স্বপ্নে দেখেন, কমলা রানী যদি দীঘিতে গঙ্গা দেবীর পূজা করেন তাহলে পানি উঠবে। রাজার কথামতো রানী সম্মতি প্রদান করলেন। পন্ডিতগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রানী পূজা সম্পন্ন করতে দীঘিতে পা রাখতেই ততনাত শুরু হলো পানি ওঠা।
এক সময় কমলা রানী পানিতে ডুবে গেলেন। জনশ্রুতি রয়েছে রানীর বাবা-মা বিলম্বে আসার কারণে গঙ্গা দেবী পুনরায় রানীকে পানির ওপর কিছুনের জন্য ভাসিয়ে ছিলেন। রাজা রানীকে হারিয়ে শোকার্ত হয়ে যখন দিকভ্রান্ত, তখন এক রাতে স্বপ্নে দেখেন, রানী রাজাকে বলছেন, প্রতিদিন সূর্যোদ্বয়ের সময় আমার দু’সন্তানকে ঘাটে নিয়ে আসবে।
আমি তাদের দুধ পান করাব। কিন্তু শর্ত হচ্ছে ১২ বছরের মধ্যে আমাকে তুমি স্পর্শ করতে পারবে না। তাহলে আমাকে আবার ফিরে পাবে। রানীর কথামতো প্রতিদিনই রাজা দু’সন্তানকে নিয়ে দীঘির পাড়ে আসেন এবং রানী সন্তানদের বুকের দুধ পান করাতেন।
রাজা দুর থেকে রানীকে অবলোকন করতেন। একদিন রাজার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। রাজা রানীর শাড়ীর আঁচল ধরলেন। ততনাত রানী লাফ দিয়ে দীঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বলতে থাকেন আমি আর দীঘিতে থাকব না। এর পরপরই একটি নৌকা ভেসে ওঠে। রাজা নৌকার মধ্যে রানীকে দেখে কমলা বলে চিতকার শুরু করেন। তখন রানী বলতে থাকেন আমি এ দীঘি থেকে চলে যাচ্ছি। সে সময় ভেসে ওঠা নৌকাটিও পানির নীচে তলিয়ে যায়।
তারপর থেকে কমলা রানীকে রাজা দেখতে পাননি। পরবর্তীতে শোক বেদনায় জর্জরিত হয়ে রাজারও অন্তর্ধান হয়। রাজার দু’সন্তানের কথা ইতিহাসের পাতায় কি অবস্থায় ছিল, তা কারোর জানা নেই। জনশ্রুতিতে জানা যায়, রাজার দুই পুত্রের মৃত্যু হয়েছিল কমলা রানীর অন্তর্ধানের পরপরই। কমলা রানীর এ কাহিনী আজো মানুষের মুখে মুখে ইতিহাসের গল্প রুপকথা কথার মতো ফুটে উঠেছে।
কৌতুহল উদ্দীপক দর্শণার্থী এ দীঘির পশ্চিম পাশে অবস্থিত হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অন্যতম সফর সঙ্গী ও ৩৬০ আউলিয়ার একজন শাহ কুতুব উদ্দিন (রঃ) চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। তার মাজার মোবারক জিয়ারতের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে ভক্ত মুরিদগণের সমাবেশ ঘটে। মাজারের দনি পাশে একটি জামে মসজিদ, মাজার অফিস ও মহিলাদের জন্য নির্ধারিত নামাজের স্থান রয়েছে। পর্যাপ্ত অর্থাভাবে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ ও রণাবেণের ব্যবস্থা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না।
তাছাড়াও কমলা রানীর দীঘির দনি পাড়ে সুপ্রাচীন স্থাপনার ভগ্নস্তুপ রাজা সুবিদ নারায়নের রাজত্বকালের স্মৃতি চিহß আজো পুরাকীর্তিটি সম্পূর্ণ অরতি অবস্থায় পড়ে আছে। পশ্চিম পাড়ে মুল ঘাটের উপরে পুনরায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন ভাবে নির্মিত হওয়ায় মুল ঘাটের স্থাপত্য শৈলী বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমান ঘাটের চেয়ে মুল ঘাটটির আয়তন এবং সিঁড়ির সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। হযরত শাহ কুতুব উদ্দিন (রঃ) বার্ষিক জলসা ৬ ফালগুন অনুষ্ঠিত হয়। জলসাতে প্রচুর ধর্মানুরাগী ও ভক্তদের আগমন ঘটে।
সে কথিত দীঘিতে যুক্তরাজ্য প্রবাসী কাদির মিয়া পরিকল্পিত মতস্য চাষ করছেন। প্রচুর মতস্য প্রতিবছর উতপাদন হচ্ছে।হযরত শাহ কুতুব উদ্দিন (রঃ) এর দরগাহের খাদেম জানান, কমলা রানীর মৃত্যুর পর রাজা সুবিদ নারায়ন সম্ভবতঃ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। দীঘির পশ্চিম পাড়ে রাজা ও তার দুই পুত্র সন্তানের কবরের ধ্বংসস্তুপ রয়েছে। অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করে যাচ্ছে কথিত কমলা রানী দীঘি ও হযরত শাহ কুতুব উদ্দিন (রঃ) এর মাজার শরীফ।
কিভাবে যাবেন: মৌলভীবাজার হইতে রাজনগর বাজারে এসে রাজনগর-বালাগঞ্জ রাস্তা দিয়ে রিক্সা, অটো রিক্সা বা বাসে করে সাগর দিঘির পাড় বললে এখানে নামিয়ে দেবে।